জমির নেশায় বুঁদ ছিলেন সাবেক এমপি আয়েন

আয়েন উদ্দিন ছিলেন ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক। ২০০৭ সালে ছিলেন কারান্তরীণ। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের ধরাশায়ী করে অল্প বয়সেই হয়ে যান রাজশাহী-৩ (মোহনপুর-পবা) আসনের সংসদ-সদস্য। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন। তবে সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাননি।

তবে দুদফায় এমপি হওয়ার পর আয়েনকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফুলেফেঁপে ওঠে তার অর্থ আর সম্পদ। ২০১৪ সালের আগে আয়েনের ব্যাংক ঋণ ছিল ১২ ল্লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এমপি হওয়ার পর তার আর ঋণ ছিল না। হয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। ঢাকা এবং রাজশাহীতে রয়েছে দামি ফ্ল্যাট এবং প্লট। এমপি থাকাকালে জমি দখলের নেশায় সব সময় বুঁদ ছিলেন।

আয়েন প্রায় ৩০০ বিঘা আয়তনের তিনটি পুকুরের মালিক হয়েছেন। বিনোদনের জন্য তৈরি করেছেন ‘জলসাঘর’। এর পাশেই রয়েছে একশ বিঘা আয়তনের একটি পার্ক। অভিযোগ রয়েছে, আয়েন তার নির্বাচনি এল্লাকার মানুষের জমি জোর করে দখলে নিতেন। এরপর জমির মালিককে রেজিস্ট্রির বিনিময়ে দিয়েছেন নামমাত্র টাকা। এজন্য ঘুরিয়েছেন বছরের পর বছর। কাউকে দেননি কিছুই। এসব কৃষকরা হয়েছেন ভ‚মিহীন। আয়েন উদ্দিন মোহনপুরের ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের তুলসীক্ষেত্র গ্রামে শিবনদীর বাঁধসংলগ্ন বিলকুমারি বিলের একপাশে একটি ঝকঝকে তিনতল্লা ভবন নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়রা এই ভবনকে আয়েনের ‘জলসাঘর’ হিসাবেই চেনেন। এই ভবনের সামনে বিশাল দীঘি। এ দীঘির আয়তন প্রায় একশ বিঘা। এর পাশেই আরও অন্তত একশ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোল্লা হয়েছে পার্ক। এর পাশেই আয়েনের রয়েছে দুইশ বিঘার আরও দুটি পুকুর। এসব জমি নামমাত্র মূল্যে বা মূল্য না দিয়েই দখল করা হয়েছে।

মূলত ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পরই ফসলি জমিতে পুকুর এবং পার্ক করার জন্য দখল শুরু করেন আয়েন। তিনি ল্লাল নিশান টানিয়ে দেন। এ সময় মোহনপুর উপজেল্লা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন বকুলের নেতৃত্বে আয়েনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন জমির মালিকরা। কিন্তু আয়েনের প্রভাব এবং ক্ষমতার কাছে টিকতে পারেননি তারা। মোহনপুরের মহিষকুণ্ডি গ্রামের বাসিন্দা অখিল চন্দ্র দাস বলেন, আমার অনুমতি ছাড়াই ৪৮ শতক জমি দখলে নিয়ে পুকুর খনন করেছেন আয়েন। জমি দিতে রাজি হইনি। তখন আমাকে বল্লা হয়েছে অন্য জায়গায় আমাকে জমি দেবেন। পরে আমাকে জমিও দেননি। টাকাও পাইনি। স্থানীয় প্রশাসনে অভিযোগ করেও কোনো ফল মেলেনি। এখন আমার জমি আয়েনের পুকুরে।

মোহনপুরের চক কৃষ্ণপুরের বৃদ্ধ আহমেদ আলী বলেন, আমাদের ৮৬ শতক জমি আয়েন হুমকি দিয়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা শতাংশ দর ধরে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। ১৯২০ সালে দাদার নামে রেকর্ড ছিল জমিটি। ধানের ফলন ভালো হতো। এই ধানের চাল বছর ধরে খেতাম। ভয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। মাত্র ১০ হাজার টাকা শতক দরে বাংল্লাদেশের কোথাও জমি নেই। এখন খেয়ে না খেয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি।

মোহনপুর উপজেল্লা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ হাবিবা বলেন, এমপি হওয়ার পর জোরপূর্বক এল্লাকার মানুষের জমি দখল করা ছিল আয়েনের প্রধান কাজ। প্রান্তিক কৃষকের জমি ক্ষমতা খাটিয়ে দখলে নিয়েছেন। কয়েকজনকে কিছু টাকা দিয়েছেন, কিন্তু যারা দুর্বল তাদের জমি জবরদখল করে নিয়েছেন। কৃষকরা কিছুই বলতে পারেননি। শুধু চোখের পানি ফেলেন। এই এল্লাকার মানুষের শান্তি কেড়ে নিয়েছিলেন আয়েন ও তার লোকজন।

অভিযোগ রয়েছে, এমপি থাকাকালে আয়েন তার নিকটাত্মীয়দের বড় বড় পদে বসিয়েছেন। নিজের আপন বড় বোনের বর আব্দুস সাল্লামকে উপজেল্লা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং উপজেল্লা চেয়ারম্যান করেছেন। বড় ভাই আজাহারুল ইসল্লাম বাবলুকে ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এনে দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান করেছেন। যদিও তিনি কখনোই আওয়ামী লীগ করেননি।

মোহনপুর উপজেল্লা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান আলী অভিযোগ করেন, জমি দখল এবং নিয়োগ বাণিজ্য করে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আয়েন উদ্দিন। এল্লাকার মানুষ আয়েন এবং তার বাহিনীর কাছে ছিলেন অসহায়।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্যের জন্য এমপি আয়েনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে তার নির্বাচনি এল্লাকা মোহনপুর এবং পবা থানায় সাতটি মামল্লা হয়েছে।