যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি মাত্র দুদিন। আগামী মঙ্গলবার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে তার আগেই অনেক রাজ্যে আগাম ভোট কার্যক্রম চলছে। এবারের নির্বাচনের আগে দেশটিতে রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট পড়েছে। এরই মধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি ভোটার। যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছে এমন মোট জনসংখ্যা ২৩ কোটির বেশি। তবে নিবন্ধিত ভোটার প্রায় ১৬ কোটি। আগাম ভোটের বুথ-ফেরত জরিপ বলছে, আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের আগে আগাম ভোটে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। এমনকি সাত দোদুল্যমান রাজ্যের আগাম ভোটে ছয়টিতেই এগিয়ে রয়েছেন কমলা। শুধুমাত্র নেভাদায় কমলার থেকে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প
এবার আগাম ভোটের হার দেখে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই শিবিরই উচ্ছ্বসিত। এবার আগাম ভোট শুরুর পর থেকে কোন প্রার্থীর ব্যালটে ভোট বেশি পড়ছে, তার একটা আন্দাজ পেতে প্রতিনিয়ত জরিপ হচ্ছে। সর্বশেষ তিনটি জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন কমলা। জরিপে দেখা গেছে, গত নির্বাচনের তুলনায় এবার বেশি আগাম ভোট পেয়েছেন রিপাবলিকানরা। তারপরও সেটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলাকে টপকে যেতে পারেনি। আগাম ভোট নিয়ে জরিপ করেছে এবিসি নিউজ-ইপসোস, নিউ ইয়র্ক টাইমস-সিয়েনা কলেজ ও সিএনএন। তিনটি জরিপেই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন কমলা। নিউ ইয়র্ক টাইমস-সিয়েনা কলেজের জরিপে ৫৯ থেকে ৪০, এবিসি নিউজ-ইপসোসে ৬২ থেকে ৩৩ এবং সিএনএনের জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে ১৯ থেকে ২৯ পয়েন্টের মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন কমলা। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়েও বেশি আগাম ভোট পেয়েছেন কমলা হ্যারিস। সে সময় তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ট্রাম্পের চেয়ে ৮ থেকে ১৬ পয়েন্ট এগিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন হিলারি।
তবে আগাম ভোটে যেই এগিয়ে থাকুক না কেন, এবারও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হবে দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্যের ভোটে। জরিপে দেখা গেছে এসব রাজ্যেও আগাম ভোটে স্বস্তিতে আছেন ডেমোক্র্যাটরা। দোদুল্যমান রাজ্যের আগাম ভোটারদের নিয়ে করা সর্বশেষ চারটি জরিপে দেখা গেছে, দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ছয়টিতে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা।
জরিপগুলো করেছে মারিস্ট, সিএনএন, ফক্স নিউজ এবং ইউএসএ টুডেÑসাফোক ইউনিভার্সিটি। জরিপে অ্যারিজোনায় ৯ থেকে ১২ পয়েন্ট, জর্জিয়ায় ৭ থেকে ১০ পয়েন্ট, মিশিগানে ২৬ থেকে ৩৯ পয়েন্ট, নর্থ ক্যারোলিনায় ২ থেকে ৬ পয়েন্ট, পেনসিলভানিয়ায় ১৭ থেকে ৩৫ পয়েন্ট ও উইসকনসিনে ২২ থেকে ৬০ পয়েন্ট এগিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন কমলা। তবে নেভাদায় কমলা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্প ৬ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিবন্ধিত ভোটারের সবাই আবার ভোট দেন না। সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৬৬ শতাংশ, যা ছিল গত দশ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে আগাম ভোটে এগিয়ে থাকলেও, এখনই জয়ের ব্যাপারে নিশ্চয়তার সুযোগ নেই। তবে যে কোনো প্রার্থীর জন্যই আগাম ভোটের জরিপে এগিয়ে থাকার অর্থ সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে মূল নির্বাচনে যাওয়া। দুই প্রার্থীর মধ্যে শেষ হাসি কে হাসবেন সেটি জানতে তাই অপেক্ষা করতে হবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচক কমলা হ্যারিস। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকেই কিয়েভকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাইডেন প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন কমলা। এমনকি বিগত কয়েক বছরে রাশিয়ার রপ্তানি খাত এবং দেশটির কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও আছে তার। যুদ্ধের অবসানে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
আর রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সে জন্য ইউক্রেনকে যদি নিজেদের কিছু অংশ ছেড়ে দিতে হয়, তাহলেও সে পথে হাঁটা উচিত বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি। এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইউক্রেনকে দেওয়া ক্রমাগত সহায়তা বন্ধ করার কথাও বলেছেন দেশটির সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ইউক্রেনের নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেছেন তিনি। তবে আসন্ন নির্বাচনে তিনি জয় পেলে সেটি ইউক্রেন যুদ্ধে বিস্তর প্রভাব ফেলবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে দুই প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কৌতূহলের কমতি নেই। কমলা-ট্রাম্প দুজনই ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতো অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছেন কমলা। তবে গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রমেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাইডেন প্রশাসন।
ইসরায়েলের কড়া সমর্থক হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট, যার ক্ষমতাকালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়। তিনিও গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের সময় ইসরায়েলের সঙ্গে একের পর এক চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অপ্রাসঙ্গিক করে তোলেন ট্রাম্প। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত ছিটমহলটিতে সংঘাতের অবসানের কথাও বলেছেন তিনি।
তবে চীনের বিষয়ে দুই প্রার্থীর পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে সেটি নিয়ে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা চলছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দুই দেশের মধ্যে নানা টানাপড়েন চলছে। চীনের উত্থানে শঙ্কিত এশিয়ার এমন দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে চেষ্টা করেছেন কমলা। লক্ষ্য চীনের আগ্রাসন প্রতিরোধে জোট তৈরি করা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ করার প্রচেষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে চীনের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প। যার ফলে নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন ও জ্বালানি অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি খাতে চীনা কোম্পানির মালিকানা নিষিদ্ধ করতে চান। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের মধ্যে যোগাযোগ চালু করেছিলেন, যা চীনকে ক্ষুব্ধ করে।
কিন্তু পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটো বিষয়ে দুই প্রার্থীর অবস্থান দুই মেরুতে। ন্যাটোকে শক্তিশালী করতে বাইডেনের মতো কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে এই জোটের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মানেন কমলা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে এই জোটের সম্প্রসারণের বিষয়টি তদারক করেছিলেন তিনি। তবে ট্রাম্প বরাবরই ন্যাটোর সমালোচনা করে এসেছেন। ন্যাটোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এমনকি এই জোট থেকে সরে আসারও হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট হটিয়ে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে এই তিন দেশ ও ন্যাটোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যে পরিবর্তন আসবে সেটি অনেকটাই নিশ্চিত। তবে যেই হোয়াইট হাউজের মসনদে বসুক না কেন, তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে। ফলে ট্রাম্প বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বললেও, তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেনÑ সেটি বলে দেবে সময়।