রাজধানীর সচিবালয়ে ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার পর ত্রিমুখী প্রতিরোধের মুখে গত রবিবার রাত ১০টার দিকে আত্মসমর্পণ করেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে থাকা একদল সাধারণ আনসার সদস্য। ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয় প্রায় ৪০০ আনসার সদস্য। প্রতিরোধের মুখে অন্যরা দিগ্বিদিক ছুটে পালান। এই খবর চাউর হতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ঢামেক ও ঢামেক বার্ন ইউনিটে কর্মরত ৪৫৩ জন্য আনসার সদস্যও কর্মস্থল ছেড়ে গা-ঢাকা দেন। গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত তারা ফেরেননি কর্মস্থলে।
শুধু ঢামেক হাসপাতালেই নয়, ঢাকার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল, হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং ক্যাম্পগুলোতে গতকাল রাত পর্যন্ত কর্মস্থলে ফেরেননি সাধারণ আনসার সদস্যরা। আন্দোলনে অংশ নেননি এমন কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আনসার সদস্যরা কাজে ফিরলেও সোমবার ভোররাতে তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জব্দ করেছেন সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। আর আন্দোলন চলাকালে রবিবার বিকাল থেকে নিজ নিজ স্টেশনে যেসব আনসার সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন তারা ক্যাম্পে ফিরতে চাইলেও সেই সব আনসারদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া গতকাল রাতে বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে দৈনিক রোস্টার ভিত্তিতে ৪ শতাধিক আনসার সদস্য নিয়োজিত থাকেন। সংঘর্ষের পর থেকে এখানকার আনসার সদস্যরা হঠাৎ উধাও হয়ে যান। গতকাল সোমবারও তারা কাজে ফেরেননি। কী কারণে তারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত, তা জানাতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিন্ন মন্তব্য করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি হাসপাতালে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা। শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়েও গতকাল দেখা মেলেনি কোনো আনসার সদস্যকে। তাদের অনুপস্থিতির বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি সংশ্লিষ্ট কেউই।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে সোনালী মৎস্য আড়তের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছেন ১০ জন আনসার সদস্য। গতকাল সোমবার বিকালে ওই আড়তের ক্যাম্পে গিয়ে কয়েকজন আনসার সদস্যকে কর্মরত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ক্যাম্পের সহকারী আনসার কমান্ডার শাহ দরবেশ আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের এই ক্যাম্প থেকে কেউই আমরা যাইনি। রাতে সচিবালয়ে আন্দোলনরত আনসার সদস্যরা আত্মসমর্পণ করার পর আমরা অনেকটাই আতঙ্কে ছিলাম। কিন্তু ছাত্র-জনতার কেউই আমাদের কিছু করেনি। ভোর ৪টার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা আমাদের ক্যাম্পে এসে রোস্টার খাতা এবং হাজিরা খাতা চেক করার পর নিশ্চিত হয় আমরা এখানেই ছিলাম। ফলে আমাদের কাউকেই নেতিবাচক কিছু বলেননি; তবে এই ক্যাম্পে থাকা চারটি অস্ত্র তারা জব্দ করে নিয়ে যান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, সচিবালয়ে আন্দালনে ছাত্র-জনতার হাতে ধরাশায়ী হওয়ার পর পালিয়ে আসা কয়েকজন আনসার সদস্য বলেন, আমরা যৌক্তিক দাবি নিয়েই আন্দোলন করি। সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়ে কমিটি গঠন করার পর আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হলে আমরা অনেকেই সেখান থেকে চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার নেতৃস্থানীয় কয়েকজন আমাদের আসতে দেননি। তারা বলেন- প্রজ্ঞাপন নিয়েই বাড়ি ফিরব। এই আশাতে বসে থেকে পরে পিটুনি খেলাম। ব্যারাকে বা ক্যাম্পে ফিরতে গেলেও রবিবার হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত থাকায় ঢুকতে পারছি না।
জানা গেছে, চাকরি জাতীয়করণের দাবির নামে গত রবিবার রাত পর্যন্ত সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে রাখা এবং ছাত্র-জনতা ও সেনা সদস্যদের ওপর হামলার নেপথ্যের নায়ক ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুল কাদের। আনসার আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা কাদের হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনসারের পিসি হিসেবে নিয়োজিত। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ষাটঘর তেওতা (বিলপাড়া) এলাকার ফজলুল হকের ছেলে তিনি। সরকারি চাকরির পাশাপাশি তেওতা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও কাজ করতেন কাদের। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া গত রবিবার দুপুরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়া আনসারদের নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন কাদের। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কাদের প্রায় ১০ বছর আগে আনসার বাহিনীতে চাকরিতে ঢুকেছেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এই আনসার সদস্য।