গুলি হামলায় নিহত শতাধিক

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গতকাল সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং সংসদ সদস্য (এমপি) ও মন্ত্রীদের বাসভবনসহ নানা স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তর ও বিভিন্ন থানায় হামলা চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। উত্তরা পূর্ব থানায় হামলা হলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর পুরো উত্তরায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সদর দপ্তরে হামলা চালালে হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ আশ্রয়ে যান বাহিনীটির মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গতকাল রাজধানীতে সংঘর্ষ-সহিংসতা ও পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫৯ জন নিহত হন।

রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, কার্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যাদের বাড়িঘর ও স্থাপনা হামলার শিকার হয়েছে তাদের মধ্যে দলটির অন্তত ১৯ জন সংসদ সদস্য (এমপি) ও চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। এ ছাড়া হামলা হয় থানা, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও জেলা পুলিশ লাইনসসহ পুলিশের অসংখ্য স্থাপনায়। এসব জায়গা থেকে লুট হয় বহু অস্ত্র। হামলা চালানো হয় কয়েকটি কারাগারেও, পালিয়ে গেছে অনেক বন্দি। দুপুরের পর থেকে শুরু হয়ে রাতেও এমন হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার আগে রাজধানীর বাইরে কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। দিনভর চলা এসব সংঘর্ষ-সহিংসতায় রাজধানীর বাইরে ৬২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল তার ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর দিয়ে হামলা-ভাঙচুর থেকে আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত হওয়ার অনুরোধ জানান। তবে এর মধ্যেই থানা, প্রধান বিচারপতি ও আইজিপির বাসভবন, পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি টিভি চ্যানেল ভবনে আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাটের খবর পাওয়া যায়।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব, ভাটারা, খিলগাঁও, কদমতলী, বাড্ডা, মিরপুর, আদাবর, লালবাগ, বংশাল, পল্লবীসহ অন্তত ১৫ থানায় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। হামলার সময় পুলিশ গুলি করলে বহু মানুষ হতাহত হয়। যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে পাঁচ শতাধিক। তাদের মধ্যে ২০ জন মারা গেছেন। সেখানে উত্তেজিত জনতার পিটুনিতে চার পুলিশ সদস্য মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। বাড্ডায় হামলায় পুলিশের সাত সদস্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হতাহত হয়েছে মিরপুর, বাড্ডাসহ অন্যান্য থানা এলাকাতেও। খিলগাঁওসহ কয়েকটি থানার পুলিশ সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে থানা ছেড়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রাবাড়ীতে থানায় আগুন দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করে বাঁচার আকুতি জানান। কিন্তু কর্র্তৃপক্ষের তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে থানাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। থানার সামনে নিরাপত্তাব্যূহ তৈরি করা হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করলে সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, ‘হাজার হাজার জনতা থানা ঘেরাও করে হামলার চেষ্টা করে। এ সময় থানা থেকে ব্যাপক গুলি চালানো হয়েছে। সেখানে তিন শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছে। সেখানে চার-পাঁচজন পুলিশও মারা গেছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, থানা ঘেরাও করে পুলিশকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলনকারীরা। তখন পুলিশের বড় একটি দল থানা থেকে বের হয়ে গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়। তারা থানা থেকে চলে যায়। এ সময় বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। থানায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য আটকা পড়ে। তাদের পিটুনি দিয়ে সেখানেই হত্যা করা হয়। দেশ রূপান্তরের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) সংবাদদাতা জানান, হাসপাতালটিতে গতকালের ঘটনায় নিহত ৪১ জনের লাশ ছিল। নিহতেদের অধিকাংশই যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার। অন্যদিকে উত্তরা এলাকার সহিংসতার ঘটনাগুলোতে ওই এলাকার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নয়জন, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে দুজন এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে সাতজনের মরদেহ ছিল।

আদাবর এলাকার বাসিন্দা জাকারিয়া জানান, আদাবর থানায় হামলা করতে গেলে পুলিশ গুলি করে। এতে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হন। থানা ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা অন্যত্র আশ্রয় নেন। পরে থানায় লুটপাট হয়।

খিলগাঁও থানার পুলিশ সদস্যরা নিজেদের রক্ষায় প্রথমে গুলি ছুড়লেও পরে টিকতে না পেরে থানা ছেড়ে চলে যান। সেখানেও অনেকে হতাহত হয়েছেন।

উত্তরা পূর্ব থানার সামনে জনরোষে পড়ে রিজার্ভ ফোর্সের দুই শতাধিক পুলিশ সদস্য বাঁচার আকুতি জানান। এই থানার সামনে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। বাড্ডা ও রামপুরা থানায়ও হামলা হয়।

নিরাপত্তার কারণে কদমতলী থানার কার্যক্রম গতকাল থেকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার শামসুল ইসলাম নয়ন।

ঢামেক হাসপাতালে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২৭৫ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা হয় বলে জানান হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন (আরএস) মো. আলাউদ্দিন।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীদের একটি দল চানখাঁরপুল দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে আসছিল। চানখাঁরপুল মোড়ে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেরুল বাড্ডায় মূল সড়কে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। রামপুরা ব্রিজের কাছে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এদিন সকাল থেকেই উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে হাজারো আন্দোলনকারী রাস্তায় অবস্থান নেয়। ভাটারা ও যমুনা ফিউচার পার্কের দিকেও জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা।

প্রধান বিচারপতি ও আইজিপির বাসায় হামলা : বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর ১৯ হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা। তারা বাসায় থাকা সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া আইজিপি বাসায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আগুন : রাত পৌনে ৮টার দিকে গুলিস্তানে পুলিশ সদর দপ্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের ভেতরে থাকা এক কর্মকর্তা জানান, দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা জীবন বাঁচাতে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান।

৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগুন : ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। দুপুর আড়াইটার দিকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসা এ স্থাপনায় লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয়। পাশের অন্য দুটি বাড়ি ও আরও কয়েকটি স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। যে যার মতো করে নিয়ে যায় জাদুঘরে রাখা ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন থেকে যাবতীয় সব কিছু।

আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন : গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বেলা ৩টার দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এর আগে সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দলটির কিছু নেতাকর্মী ওই কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। পরে পরিস্থিতি বুঝে তারা বেরিয়ে যান। নিচতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা হয়। এ সময় সেখানে দলটির কোনো নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন না। তবে কার্যালয়টির তিনজন কর্মচারী থাকলেও হামলার কয়েক মিনিট আগে তারা বেরিয়ে যান। ভাঙচুর করে ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

শিশু পার্কের স্থাপনা ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে আগুন : দুপুর ২টার দিকে শিশু পার্কের নির্মাণাধীন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। এই পার্কের মাঝের জায়গায় বঙ্গবন্ধুর একটি বিশাল ম্যুরাল স্থাপন করা হচ্ছিল। সেটিতে আগুন দেওয়া হয়। পাশেই শেখ পরিবারের আরও কয়েকজনকে নিয়ে কয়েকটি ভাস্কর্য ছিল। সেগুলোতেও আগুন দেওয়া হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় আগুন : ধানম-িতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বাসা ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া থানা আওয়ামী কার্যালয়সহ অর্ধশতাধিক স্থানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

নওগাঁয় খাদ্যমন্ত্রীর বাড়িসহ কয়েক এমপির বাড়িতে আগুন : নওগাঁয় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বাড়িসহ কয়েকজন এমপির বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বিকেল ৪টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলার পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শহরের পোস্ট অফিসপাড়ায় খাদ্যমন্ত্রীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারপর পর্যায়ক্রমে শহরের সরিষাহাটি মোড়ে নওগাঁ-৫ আসনের এমপি ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন, নওগাঁ সদরের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক এবং নওগাঁ-৬ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক সুমনসহ জেলা আওয়ামী লীগ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বহু নেতার ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

সিলেটে মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে হামলা-লুটপাট : সিলেট নগরীর বন্দরবাজারে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এমপি ড. এ কে আবদুল মোমেনের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। তাদের ঘরের ফ্রিজি, টিভি, খাট, সোফা, চেয়ারসহ সবকিছু নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর টিলাগড়ের বাসায়ও হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি রনজিত সরকার, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন ও সহসভাপতি আসাদ উদ্দিনের বাসা এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহি উদ্দিন সেলিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করে সবকিছু লুটে নেওয়া হয়েছে। সিলেট জেলা পরিষদ ও পুলিশ সুপার কার্যালয়েও হামলা হয়েছে।

সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রী পলকের বাসায় লুটপাট : নাটোরের সিংড়ায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলকের বাসায় ভাঙচুর ও মালামাল লুট করা হয়। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সিংড়া পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বহু আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হামলা হয়েছে।

ভৈরবে ক্রীড়ামন্ত্রীর বাড়িতে হামলা : কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী এবং বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানের (পাপন) বাসভবনে হামলা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা চত্বর ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

বরিশালের সাবেক মেয়রের ভবনে আগুন : বরিশালে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির কালীবাড়ি রোডের বাসভবনে বিকেলে আগুন দেওয়া হয়। সেখানে ফায়ার সার্ভিসকে যেতে বাধা দেয় বিক্ষুব্ধরা। প্রায় এক ঘণ্টা পর সন্ধ্যার দিকে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বাড়িটি থেকে পুড়ে অঙ্গার হওয়া তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়ায় মৃতদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এই বাড়িতে থাকতেন আবুল হাসানাতের বড় ছেলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাড়িটিতে আগুন দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেও দোতলার বারান্দায় তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সাদিক নিরাপদে বাড়ি ছেড়েছেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ ছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর এমপির ব্রাউন্ড কম্পাউন্ড সড়কের বীরউত্তম ভবনে। সিটি করপোরেশনের এনএক্স ভবন ও আওয়ামী লীগ অফিসেও আগুন দেওয়া হয়।

নড়াইলে মাশরাফীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ : জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, নড়াইল-২ আসনের এমপি ও হুইপ মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। এ সময় মাশরাফী ও তার পরিবারের দুর্লভ ছবি, ট্রফিসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতার বাড়িতে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়।

আরও অনেক এমপির বাড়িতে হামলা : বগুড়ায় বেলা ৩টার দিকে সদরের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুর বাসভবনে লুটপাট, ভাঙচুর ও গ্যারেজ থেকে পাজেরো জিপগাড়ি বের করে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

নাটোরে এমপি মো. শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেস আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। শহরের একই এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এমপি খান আহমেদ শুভর অফিস, মির্জাপুর ক্লাব, সাবরেজিস্টার অফিস, ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

মাগুরায় বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, মাগুরা-১ আসনের এমপি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের রাজনৈতিক কার্যালয় এবং শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব ও সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখর, মাগুরা-২ আসনের এমপি ড. বীরেন শিকদার ও জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জাহিদুল আলমের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

নীলফামারীতে সাবেক এমপি আফতাব উদ্দিন সরকারের বাড়িতে হামলা হয়। লক্ষ্মীপুরে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এ ছাড়া ফেনীতে এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, পটুয়াখালীতে গলাচিপা-দশমিনার এমপি এসএম শাহজাদা, লালমনিরহাটে এমপি মোতাহার হোসেন ও মতিয়ার রহমান এবং সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বাড়িতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়।

যশোরে শাহীন চাকলাদারের হোটেলে আগুন, নিহত ২১ : যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের পাঁচ তারকা হোটেলে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটছে।

চট্টগ্রামে নগরে কোতোয়ালি, পতেঙ্গা ও চান্দগাঁও থানায় আগুন দেওয়া হয়েছে। মিছিল থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও হামলা হয়েছে। নগর পুলিশের সদর দপ্তরেও হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। বিকেলে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। আওয়ামী লীগ নেতা সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এবং রাউজানের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাসায়ও আগুন দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে সহিংসতার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ তিনজনকে মৃত অবস্থায় সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। এ ছাড়া এ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হন ১৭৫ জন।

সাভারে নিহত ৮ : ঢাকার সাভারে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে আটজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অর্ধশতাধিক। সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মুন্সীগঞ্জে সদর থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। থানায় থাকা পুলিশের অস্ত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে তারা। এ ছাড়া পুলিশ লাইনসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের বাসভবনে হামলা ও লুটপাট হয়।

গাজীপুরে সংঘর্ষে নিহত ৯ : গাজীপুরের শ্রীপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন এবং গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানায় পুলিশের গুলিতে একজন ও কালিয়াকৈরে আনসার সদস্যদের গুলিতে দুজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী ও উৎসুক জনতা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ সময় শ্রীপুরে বিজিবির তিনটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

বিক্ষুব্ধরা থানা, কারাফটক, মেয়র ভবন, সাবেক এমপিসহ কয়েকজন যুবলীগ নেতার বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয়।

মানিকগঞ্জের সিংগাইরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং ধল্লা পুলিশ ক্যাম্পে হামলা হয়েছে।

হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত ৬ : হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হয়েছেন। সকালে বানিয়াচং থানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। গুলিতে আহত হন অর্ধশতাধিক। এ সময় বিক্ষুব্ধরা থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

খুলনায় উপজেলা চেয়ারম্যানসহ নিহত ২ : খুলনার কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জিএম মহসিন রেজাসহ দুজন পিটুনিতে নিহত হয়েছেন। নিহত অন্যজন হলেন জিএম মোহসীন রেজার গাড়িচালক আলমগীর। এ ছাড়া তার দেহরক্ষী ইয়াকুবের অবস্থা সংকটাপন্ন। বিকেল ৪টার দিকে কয়রা উপজেলা সদরে এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া খুলনা মহানগরীতে সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপির বাসভবন, খুলনা বেতার ভবন, মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা পরিষদ ভবন, খুলনা প্রেস ক্লাব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সোহেলের পেট্রোলপাম্প, এসএম কামাল হোসেনের নগরীর খালিশপুরের বাসভবন, দৈনিক দেশ সংযোগ কার্যালয় এবং নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

পাটুরিয়া ঘাটে পুলিশের গুলিতে নিহত ১ : মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় পুলিশের গুলিতে রফিক (২৬) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। বিক্ষুব্ধরা শিবালয় থানায় হামলা চালিয়ে দুটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

চাঁদপুরে পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত ২ : চাঁদপুরে কচুয়া থানার এসআই মামুনুর রশিদ পিটুনিতে ও ফরিদগঞ্জে বিক্ষুব্ধরা থানায় হামলার চেষ্টাকালে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত (২০) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গায় যুবলীগ নেতার বাড়িতে আগুনে নিহত ৪ : চুয়াডাঙ্গা শহরের সিনেমা হলপাড়ায় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলমের বাড়িতে দেওয়া আগুনে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় নিহতদের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।

রাজশাহীতে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা : রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করা হয়েছে। বিকেলে মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সদর দপ্তরে আগুন দেওয়া হয়। আরএমপির বেশিরভাগ থানা ও ফাঁড়িতে। নগর ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। নগরীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার ও রিসোর্টে ভাঙচুর করা হয়েছে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালাতে গেলে সেনাসদস্যরা তা প্রতিহত করেন। উপশহরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নগরীর রানীবাজারে লিটনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের বহুতল ভবন ‘সরকার টাওয়ার’-এ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কুমারপাড়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

শেরপুরে কারাগারে হামলা : শেরপুর জেলা কারাগারে বিক্ষুব্ধ লোকজন ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে। এ সময় কারাগারে থাকা ৫১৮ বন্দির সবাই পালিয়ে গেছে। এ সময় কারাগারে থাকা অস্ত্র ও মূল্যবানসামগ্রী লুটের ঘটনা ঘটে। গতকাল বিকেলে এ ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো, সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যে প্রতিবেদনটি তৈরি