এক মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ২০ হাজার কোটি

ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এক মাস আগে মে মাসে যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে জুনে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ওই মাসটি ছিল কোরবানি ঈদের মাস। এ সময় মানুষের টাকার চাহিদা বাড়ে। আবার তথ্য গোপন করে সরকারকে ছাপিয়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থায়ও চির ধরেছে। ওই সব ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেন আমানতকারীরা। ফলে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। জানা যায়, মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে ফেরত আসে না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহও বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে সেটির কার্যকারিতা কম। মুদ্রার সরবরাহ কমার চেয়ে বাজারে উল্টো সরবরাহ বেড়ে গেছে। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে সার ও বিদ্যুতের পাওনা বাবদ বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া সরকারের বন্ড সুবিধা। টাকা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করতে না পেরে বিভিন্ন ব্যাংকের বিপরীতে বন্ড ইস্যু করেছে সরকার। ব্যাংকগুলো এই বন্ড জমা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে। আবার সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে দেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের এ ঋণ। এতে জুন শেষে অস্বাভাবিক বাড়ে রিজার্ভ মুদ্রার সরবরাহ। মুদ্রা সরবরাহ কতটা বাড়ল : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার স্থিতি (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকায়। আর সর্বশেষ জুনে রিজার্ভ মানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। জানা গেছে, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে দেওয়া হয় বিপুল অঙ্কের এ ঋণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, নতুন ঋণ না নিয়ে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা আগের দায় সমন্বয় করেছে। সরকার পরিবর্তনের পর তথ্য গোপন করে টাকা ছাপিয়ে এ ঋণ দেওয়ার ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। সাধারণভাবে সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যু করে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়। গত বছরের জুনের আগ পর্যন্ত বিল ও বন্ডের নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর তা আরোপিত (ডিভল্বমেন্ট) হতো। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারকে দেওয়া ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই দেয় ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেও তাই দেখানো হয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ দেখানো হয় ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দেখানো হয় ৯৭ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণ না বেড়ে উল্টো ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মতো উপকরণ ইস্যু ছাড়াও সরকার জরুরি প্রয়োজনে ‘উপায়-উপকরণ আগাম’ এবং ‘ওভার ড্রাফট’ হিসেবে ঋণ নিতে পারে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত দুটি ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারিত ছিল আট হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত যা ছয় হাজার কোটি টাকা ছিল। তবে সম্প্রতি সীমা বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। সীমার বাইরে সরকারের জরুরি টাকার দরকার হলে নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করে তা নিতে পারবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ‘ওভার ড্রাফট’ খাতের সীমা সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করতে পারে। তবে ঋণ ৯০ দিনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে সরকারকে ওভার ড্রাফট খাতে ঋণ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত জুনে এর স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গভর্নরের মৌখিক নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে নিয়ম লঙ্ঘন করে সরকারকে সীমার বেশি কবে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওভার ড্রাফট খাতে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার ঋণস্থিতি ছিল গত বছরের ২৬ জুন। এর মানে সীমার বেশি ছিল ৬২ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। পরের দিন ২৭ জুন স্থিতি নামে ৫৫ হাজার ২২০ কোটি টাকায়। অর্থবছরের শেষদিন কমিয়ে আনা হয় ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকায়। সাধারণত বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দেয়, বাজারে টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সরাসরি কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। কেননা সরাসরি ঋণ দিলে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। টানা আট মাস ধরে মানুষের হাতে নগদ টাকার বাড়ছে : গত নভেম্বর থেকে ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, মে মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি এবং সর্বশেষ জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ আট মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ৪৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ অর্থ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।